ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের ছেলে হুইলচেয়ারে বসেই স্বপ্নজয়!

0
11

তাপস কর,ময়মনসিংহ প্রতিনিধি।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের ছেলে নূর নাহিয়ান অন্য সবার মতো স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে উঠছিলেন। দেখতেন বড় ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় হঠাৎ তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। স্পাইনাল কর্ডে রক্ত জমে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। চলার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয় হুইলচেয়ার। তবুও থেমে থাকেননি। হুইলচেয়ারে বসেই নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে হেঁটে চলেছেন খেলে যাচ্ছেন ক্রিকেট। নূর নাহিয়ানের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার জয়পুর গ্রামে। তার বাবা লেখক, গবেষক, কবি ড. আমিনুর রহমান সুলতান বাংলা একাডেমির উপপরিচালক পদে কর্মরত। নাহিয়ানের মা শিলু রহমান একজন শিক্ষক। সুলতান-শিলু দম্পতির একমাত্র সন্তান নাহিয়ান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে পড়াকালে প্যারালাইজড হয়ে যান। দেশে ও ভারতে অনেক চিকিৎসা করানো হয় নাহিয়ানকে। প্রথমদিকে ক্রাচ দিয়ে হাঁটতে পারলেও ২০১১ সালে ভুল থেরাপির কারণে বাম পায়ের জয়েন্ট খুলে যায়। সেই থেকে নাহিয়ানের চলাচলের সঙ্গী হুইলচেয়ার। তরুণ নাহিয়ানের প্রতিবন্ধকতা শুরু হলে পড়ালেখায় কিছুটা ব্যাঘাত ঘটে। তারপরও নানাবাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার চয়ং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে এসএসসি এবং গোদাগাড়ি স্কুুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। পরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন ২০১৯ সালে। হুইলচেয়ারে বসেই সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলা নাহিয়ান বলেন, বিসিবির অধীনে খেলার স্বপ্ন ছিল কৈশোরে। একটি রোগ সব ওলটপালট করে দিল। পা দুটি অচল হয়ে যাওয়ার পর ২০১১ সালে নানাবাড়ি রাজশাহী বেড়াতে গিয়ে অন্যদের খেলা দেখতাম। বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে উঠত! তাদের খেলা দেখতে দেখতেই ভাবতাম, পা অচল তো কী হয়েছে, হাত দুটি তো ঠিক আছে! হুইলচেয়ারে বসেই মামাতো ভাইকে নিয়ে নেমে পড়লাম প্র্যাক্টিসে। সেই থেকে শুরু। ২০১৬ সালে দেশে হুইলচেয়ার ক্রিকেট শুরু হয়। সেখানে রাজশাহীর হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন নাহিয়ান। ওই সময় সারাদেশ থেকে ৩২ জন হুইলচেয়ার ক্রিকেটার খেলায় অংশ নেন। ২০১৭ সালে ভারতের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে অনুষ্ঠিত খেলায় বাংলাদেশ দল জয়ী হয় ২-১ সিরিজে। ওই সিরিজে দেশের হয়ে সহঅধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন নাহিয়ান। পরে দেশ ও দেশের বাইরে অনেক সিরিজ খেলেছেন। অদম্য নূর নাহিয়ান ২০১৮ সালে বাংলাদেশ হুইলচেয়ার স্পোর্টস ফাউন্ডেশন গঠন করেন। এর সভাপতি তিনি। এই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আগ্রহী প্রতিবন্ধীদের খেলাধুলায় পারদর্শী করে আগামী প্যারা অলিম্পিকে অংশ নিতে চান। সে জন্য ইতোমধ্যে সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন তিনি। স্বাপ্নিক নূর নাহিয়ানকে তার নিজ এলাকা খৈরাটি গ্রামের শহীদ আবদুল মতিন বিশেষ শিক্ষা একাডেমির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নাহিয়ানও তার ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়টির প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বই উপহার দেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন ফুল ও ক্রেস্ট দিয়ে শুভেচ্ছা জানান নাহিয়ানকে। বিদ্যালয়ের সভাপতি বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সময় বক্তব্য দেন নাহিয়ানের বাবা বাংলা একাডেমির উপপরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মিজানুল ইসলাম আকন্দ, সদর ইউপি চেয়ারম্যান আবু হানিফা, সাবেক চেয়ারম্যান হারিছ উদ্দীন আহমদ, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেস ক্লাব সভাপতি আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। ওই সময় নাহিয়ান বলেন, স্বপ্ন ছিল বিসিবির অধীনে ক্রিকেটার হওয়ার। সে স্বপ্ন কালো মেঘ এসে শেষ করে দেয়। তবুও হুইলচেয়ারে বসেই খেলাটা চালিয়ে যেতে শুরু করি। যখন দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করি, তখন অন্য রকম এক অনুভূতি হয়। শহীদ আবদুল মতিন বিশেষ শিক্ষা একাডেমির সভাপতি বজলুর রহমান বলেন, প্রতিবন্ধী ও স্বাভাবিক সব শিক্ষার্থীর জন্যই বড় অনুপ্রেরণা নূর নাহিয়ান। তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত। আমিনুর রহমান সুলতান বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেই কেউ স্বপ্নহীন হয়ে পড়বে, তা ঠিক নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তার পরিবারের ইচ্ছা ও একাগ্রতা থাকলে অবশ্যই স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সব প্রতিবন্ধীই এগিয়ে যাবে- এই স্বপ্ন দেখি; দেখে নাহিয়ানও। ইউএনও জাকির হোসেন বলেন, নূর নাহিয়ান সত্যি অদম্য। শারীরিক প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে স্বপ্নচূড়ায় এগিয়ে যাচ্ছে সে। নাহিয়ান অন্যদের প্রেরণা হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here