বিস্তারিত: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি কর্মকাণ্ড নেপথ্যে প্রেরণার ধাত্রী এই অসামান্য নারী। নিজে আড়ালে থেকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা উৎসাহ এবং সাহস যুগিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। সংসারের সমস্ত ভাবনা থেকে নির্ভার রেখেছেন তাকে যেন তিনি দেশের জন্য নিশ্চিন্তে কাজ করে যেতে পারেন। তার সহ্য ক্ষমতা নিজে বঞ্চিত হয়েও হাসিমুখে ত্যাগ করার ক্ষমতা বঙ্গবন্ধুর জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম কারণ।
১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তিন বছর বয়সে বাবা ও পাঁচ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু হলে বঙ্গবন্ধুর মায়ের কাছেই বড় হতে থাকেন তিনি।
শাশুড়ির স্নেহে বড় হতে থাকা ফজিলাতুন্নেছা নিজের আগ্রহে বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছিলেন। পড়াশোনার অভ্যাসটা পরবর্তী জীবনেও ধরে রেখেছিলেন তিনি। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ধৈর্য অসীম সাহসের সমন্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অসামান্য নারী।
স্বামীর পড়াশোনা এবং রাজনীতির কারণে অধিকাংশ সময়ই স্বামীর কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়েছে তাকে। একাই সংসার-সন্তান সামলে নিয়েছেন অবিচলভাবে। অথচ স্বামীর কর্মকান্ডে কখনো বাধা না হয়ে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন সাধ্যমত।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অফুরান প্রেরণার উৎস হয়েছিলেন তিনি।
ছয় দফার ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু যখন বারবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তখন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা বঙ্গ মাতার কাছে ছুটে আসতেন।তিনি তাদেরকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পৌঁছে দিতেন এবং লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাতে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যখন জাতির পিতা জেলে তখন তাকে পেরোলে মুক্তি নিয়ে লাহোরে বৈঠকে অংশ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু বেগম মুজিব পেরোলে মুক্তির বিপক্ষে দৃহচেতা অবস্থান গ্রহণ করেন এবং বঙ্গবন্ধুকে বৈঠকে যোগ না দেয়ার অনুরোধ জানান। বঙ্গবন্ধু সেদিন সহধর্মিণীর আহবানে সাড়া দিয়ে বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যা স্বাধীনতাকে আরও ত্বরান্বিত করে।
পরবর্তীতে ঊনসত্তর এর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর সাত ই মার্চের ভাষণে ও বঙ্গমাতার অবদান রয়েছে বলে জানা যায় তার তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে। স্বাধীনতার প্রতিটি ধাপে অবদান রয়েছে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ বাঁচিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিতেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেও দিশেহারা হননি তিনি। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য নিজের দুই বীর সন্তান শেখ কামাল ও শেখ জামাল কে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন ও যোগাযোগ রেখেছেন মুক্তি সংগ্রামীদের সাথে। তিনি নিজের গয়না বিক্রি করেও স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছেন। কঠিন সময়ে দৃহতা বজায় রাখার দারুন ক্ষমতা ছিল তার।
স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর সমস্ত কর্মকাণ্ডের মাঝে বঙ্গমাতার নিরব অবদান রয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি। বীরাঙ্গনাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে তাদের ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা এবং সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতেও তিনি সহায়তা করেছিলেন। মাতৃস্নেহে যত্ন করতেন সবাইকে। দেশের রাষ্ট্র পতির স্ত্রী হয়েও সাদাসিদা জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। স্বামীর আদর্শের সাথে মিলিয়ে মানুষ করেছিলেন নিজের সন্তানদের।
১৫ ই আগস্ট সেই কাল রাত্রিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। সারা জীবন দেশের জন্য অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করা এই মহীয়সী নারী নিজের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে গেলেন।
পর্দার আড়ালে রয়ে যাওয়া এই মহীয়সী বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে কি অবদান রেখেছেন তা শুধুমাত্র কিছু শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
এমন একজন সহধর্মিনী না থাকলে একজন বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া সহজ হতোনা হয়তো।
সুদীর্ঘ সময় ধরে স্মরণের অন্তরালে থাকা এই মহীয়সীর স্মৃতি অম্লান রাখতে ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে গাজীপুরের জিরানিতে স্থাপিত করা হয় শহীদ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমী।
২০১২ সালের জুলাই থেকে রাজস্ব বাজেটের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে।
এখানে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীরা বিভিন্ন ধরনের দক্ষতা অর্জন করে কর্মজীবনে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে।
সেবার প্রতীক হিসাবে বঙ্গমাতার স্মৃতিতে সম্প্রতি দুটি চিকিৎসালয় গড়ে তোলা হয়েছে।
২০১১ সালে গোপালগঞ্জ জেলার গোবরা ইউনিয়নে ঢাকা ও খুলনা মহাসড়কের পাশে ১০০ শয্যা বিশিষ্ট শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক প্রস্থ স্থাপন করেন তারই কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৩ গাজীপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কে,পি,জে বিশেষায়িত হাসপাতাল ও নার্সিং কলেজ। একজন ত্যাগী ও মমতাময়ী বাঙ্গালী মায়ের আদর্শ উদাহরণ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদান এর তুলনায় এই স্মরণ যথেষ্ট নয়।
তিনি জীবনভর অন্যের সেবা করে এসেছেন নারীর উন্নয়নের জন্য নারী স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।
তার সেই গূন ধারণ করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনদরদি দেশ প্রেমিক ও সাহসী রাষ্ট্রনেতা তারই কন্যা শেখ হাসিনা।
এমন এক মেয়ের জন্ম দিয়েছেন যে মা এ জাতীর আত্ম পরিচয়ের জন্য বাঙালির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন যে মা সেই বঙ্গমাতার অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন।
লেখক পরিচিতিঃ
মোঃ আজিজুল হক
বিডি স্টার.টিভি নেত্রকোনা দুর্গাপুর প্রতিনিধি।